
মাদকমুক্ত সমাজ: স্লোগানে নয়, বাস্তবতায় প্রয়োজন পরিবর্তন
— মো. রাসেল আহমেদ (রাফি)
মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার কথা আমরা প্রায়শই শুনি। রাজনৈতিক অঙ্গন, সামাজিক সংগঠন, এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও এই স্লোগান উচ্চারিত হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, যারা এই স্লোগানের নেতৃত্বে থাকে, তাদের অনেকেই মাদকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এ ধরনের দ্বিচারিতা আমাদের মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্নকে দুর্বল করে তোলে।
মাদক সমস্যা: ভয়াবহ বাস্তবতা
বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ নানা মাদকের সহজলভ্যতা এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বলতা মাদকের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে।
অন্যদিকে, মাদকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর দায়িত্বে থাকা অনেকেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, যা একটি দ্বিমুখী চিত্র তৈরি করে। এতে সাধারণ জনগণের মাঝে হতাশা এবং আইন ও প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা জন্মায়।
মাদকমুক্ত সমাজের পথে করণীয়
মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে শুধুমাত্র স্লোগান নয়, প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। কিছু গঠনমূলক উদ্যোগ হতে পারে:
১. ব্যক্তিগত শুদ্ধতা
মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য প্রথম ধাপ হলো ব্যক্তিগত শুদ্ধি। সমাজের নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের আগে নিজেদের জীবনযাপন মাদকমুক্ত করতে হবে। নৈতিকতার এই উদাহরণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে।
২. আইনের কঠোর প্রয়োগ
মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের (২০১৮) যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে, মাদকের মূল গডফাদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। কেবলমাত্র নিম্নস্তরের মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করলে সমস্যার সমাধান হবে না।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি
পরিবার, স্কুল, কলেজ, এবং কর্মক্ষেত্রে মাদকের কুফল নিয়ে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে।
৪. সামাজিক দায়বদ্ধতা
মাদক নিয়ন্ত্রণে সমাজের প্রতিটি স্তরে দায়বদ্ধতা থাকা জরুরি। বিশেষ করে মসজিদ, মন্দির এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো যেতে পারে।
৫. মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রের উন্নয়ন
মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ।
মাদকমুক্ত সমাজ: একটি চলমান প্রক্রিয়া
মাদকমুক্ত সমাজ গঠন কোনো তাৎক্ষণিক কাজ নয়। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে সবার আন্তরিক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকলেই কেবল মাদকমুক্ত সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।স্লোগান আর বক্তৃতার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সৎ, দৃঢ়, এবং কার্যকর পদক্ষযদি আমরা নিজেদে রকে মাদকমুক্ত রাখতে পারি এবং দায়িত্বশীল আচরণ প্রদর্শন করি, তাহলে একটি সুন্দর, সুস্থ, এবং মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা কোনো দূরাশা থাকবে না।
লেখক: আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, ও সমাজসংগঠক।